ইয়েমেনে পাঁচ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। এই যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের কাছে ব্রিটেনের অস্ত্র বিক্রির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছেই।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেল সমৃদ্ধ সৌদি আরব বিশ্বে অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা দেশ। আরব দুনিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র এবং নিজেদের প্রতিবেশী ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের দমনে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব।
গত বছরের এক প্রতিবেদনে ব্রিটেন নিজেকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ অস্ত্র বিক্রেতা বলে উল্লেখ করেছে। ব্রিটেন যত অস্ত্র রফতানি করে তার ৪০ শতাংশই বিক্রি করে সৌদির কাছে।
অপরদিকে, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদির পাশে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ সরকারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারাও ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার তালিকায় ওপরের দিকেই রয়েছে।
ব্রিটেন অস্ত্র বিক্রি করে যে কোটি কোটি পাউন্ড মুনাফা পাচ্ছে তাতে ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। এর ফলে ইয়েমেনে কী ধরনের মারাত্মক প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে ব্রিটেনের বিরোধী রাজনীতিক ও অস্ত্র ব্যবসার বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন।
জাতিসংঘ বলছে, ইয়েমেনে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ইয়েমেনে মূলত সৌদি নেতৃত্বাধীন বিমান হামলায় বেসামরিক মানুষ মারা গেছে অন্তত ৭ হাজার ৭শ জন।
তবে বেশ কিছু পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী অবশ্য বলছে যে, সেখানে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এসিএলইডির (আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এর মধ্যে সরাসরি হামলায় নিহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার।
ইয়েমেনের জনসংখ্যা দুই কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের মানবিক সহায়তা এবং সুরক্ষার প্রয়োজন।আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে বিশ লাখ শিশু গুরুতর অপুষ্টির শিকার। এদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুর বয়স পাঁচ বছরের নিচে।
মধ্যপ্রাচ্যে বিমান হামলায় হতাহাতের বিষয়টি নজরদারিতে নিয়োজিত ব্রিটিশভিত্তিক সংস্থা এয়ারওয়ারস বলছে, সৌদি আরবকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার প্রক্রিয়া সন্দেহজনক এবং অনির্ভরযোগ্য।
ওই সংগঠনের দাবি, মিত্র দেশ সৌদির কথা যদি ছেড়েও দেয়া হয়, তারপরেও ব্রিটেনের যে সংখ্যক বিমান ইয়েমেনে হামলা চালিয়েছে তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।
তিনি বলেন, ব্রিটেন তদন্তের ক্ষেত্রে যেসব মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে, তাতে বেসামরিক মানুষের ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে নেয়ার পথ অসম্ভব করে দেয়া হয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসাবে সিরিয়া ও ইরাকে ব্রিটেন আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ৪ হাজার ৪শ অস্ত্র দিয়েছে।
ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সদস্য দেশগুলোর কাছে ব্রিটেনের বিক্রি করা অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের মূল্য অন্তত ১৬ বিলিয়ন পাউন্ড।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশানাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, সৌদি আরব ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত যে পরিমাণ অস্ত্র আমদানি করেছে তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্রিটেন। সৌদিতে মোট আমদানি করা অস্ত্রের ১৩ শতাংশ ব্রিটেনের এবং ৪ দশমিক ৩ শতাংশ ফ্রান্সের।
ব্রিটেনের সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোমিনিক রাব এক নিবন্ধে লিখেছেন যে, ব্রিটেন ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে এবং মানবিক ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নিচ্ছে।
ইয়েমেনে দেশজুড়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, দেশটিতে জাতিসংঘের কর্মকাণ্ডে সাহায্য করার জন্য ব্রিটেন, জার্মানি এবং সুইডেন যৌথভাবে অতিরিক্ত ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ইয়েমেনে ব্যাপকহারে কলেরার প্রাদুর্ভাব ছাড়াও দেশটি কোভিড-১৯-এর প্রকোপ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে।
এদিকে, জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে যে, ইয়েমেনে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ বছরের যুদ্ধে দেশটিতে যে প্রাণহানি হয়েছে তাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
পাঠকের মন্তব্য