বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস আজ
সরকারি অনুমোদনে বিদেশ গিয়েও প্রতারিত হচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই, তবুও টাকা হাতাতে কর্মী পাঠাচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ‘স্বার্থে’ তাতে ছাড়পত্র (স্মার্টকার্ড) দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। কর্মী বিদেশে গিয়ে প্রতিশ্রুত চাকরি না পেলে নির্যাতিত রিক্রুটিং এজেন্সির কখনও কখনও শাস্তি হলেও কর্মী পাঠানোর অনুমোদন দেওয়ার দায় নেয় না বিএমইটি, দূতাবাস কিংবা মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি ভিয়েতনাম থেকে যেসব কর্মী ফিরেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটেছে। চলতি মাসের শুরুতে দেশে ফেরা ১১ কর্মীর ৯ জনের বৈধ স্মার্টকার্ড রয়েছে। তারা সরকারি সব নিয়ম-কানুন মেনে, ফি দিয়ে দেশটিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি না পেয়ে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন। গত মে মাসে লিবিয়া হয়ে সাগরপথে ইউরোপ পাড়ি জমানোর সময় জিম্মিকারী দালালের গুলিতে ২৬ জন নিহত হন। গত মাসে মেসোডোনিয়ায় উদ্ধার হয় ৬৩ বাংলাদেশি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টায় মেক্সিকোতে ধরা পড়ে জেলে আছে সাড়ে তিনশ’ বাংলাদেশি। ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশের বনে-জঙ্গলে বহু বাংলাদেশির প্রাণ গেছে উন্নত দেশে পাড়ি দেওয়ার আশায়। ইউরোপের স্বপ্নে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরেছেন বহু বাংলাদেশি।
তাদের সবাই অবৈধভাবে বিদেশ যেতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। তাদের কারও বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ার বৈধ ছাড়পত্র ছিল না। এসব ঘটনাকে মানবপাচার বলা হচ্ছে। কিন্তু আড়ালে থেকে যাচ্ছে চাকরির প্রলোভনে বৈধভাবে বিদেশ পাঠিয়ে প্রতারিত করার ঘটনাগুলো।
এসব বিষয়ে সচেতনা সৃষ্টির জন্য আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস।
ভিয়েতনামের হ্যানয়ের বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, দেশটিতে আসলে বিদেশি কর্মীদের কোনো চাকরির সুযোগই নেই। দূতাবাস ছয় বছর পর এসে এ কথা বললেও ২০১৪ সাল থেকে ভিয়েতনামে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে বিএমইটি। এ পর্যন্ত বৈধভাবে এক হাজার ২৭৫ জন বাংলাদেশি পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে গিয়েছেন চাকরি করতে। কিন্তু তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছাড়া বাকিরা চাকরি পাননি। কেউ কেউ দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যখন যা পাচ্ছেন, তাই করে পেট চালাচ্ছেন। দেশে ফিরতে ধরনা দিচ্ছেন অনেকেই। অন্তত ৬২ জন দূতাবাসে অবস্থান করছেন দেশে ফেরার দাবিতে।
তাদের একজন কুমিল্লার দাউদকান্দির মাসুম মুন্সি। গত বছরের মার্চে সরকারের সব অনুমোদন ও বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে স্থানীয় দালাল মোজাম্মেলের মাধ্যমে তিনিসহ পাঁচজন ভিয়েতনাম যান। সেখানে তাদের মাসে ৮০০ ডলার বেতনে শিপইয়ার্ডে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিন মাস থেকে চাকরি না পেয়ে ৫০ হাজার টাকা করে বিমান ভাড়া দিয়ে গত জুলাইয়ে দেশে ফেরেন।
দেশে ফিরে মাসুমসহ পাঁচজন দালালকে টাকার জন্য চাপ দিলেও গত জানুয়ারিতে ৪০ হাজার টাকা করে নিয়ে একই ছাড়পত্রে আবার তাদের ভিয়েতনাম পাঠায় ‘সন্ধানী ওভারসিজ লিমিটেড’ নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সি। কিন্তু এবারও তারা কাজ পাননি। চাকরি চাইলে ভিয়েতনামে থাকা বাংলাদেশি দালাল আতিক, সাইফুল ও আকরাম তাদের মারধর করে। মাঝে মাঝে এক-দুই দিনের খণ্ডকালীন কাজ দেওয়া হয়। তবে তা শিপইয়ার্ডের কাজ নয়। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ। তাতে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে ২০০-২৫০ টাকা পেতেন।
নির্যাতনের কারণে গত ২১ জুলাই হ্যানয়ে দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেন মাসুম, রায়হান উদ্দিন, মো. রুবেলসহ ১৭ বাংলাদেশি। পাঁচ দিন রাস্তায় বসে থাকার পর ভিয়েতনাম পুলিশের চাপে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে এনপিএক্স নামের একটি ভিয়েতনামি প্রতিষ্ঠান। তারা কাগজেকলমে সবাই এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী।
মাসুম জানান, প্রতিষ্ঠানটি কাগুজে। এনপিএক্স লিমিটেডের নামে তাদের আনা হলেও আদলে এই প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি নেই, চাকরি ও বেতন দেওয়ার সক্ষমতা নেই। দুই দেশে থাকা দালালরা মিলে এনপিএক্সের মতো কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয় ভিয়েতনামে। কর্মীপ্রতি সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো চাকরি দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে কর্মী যেতে বিএমইটির ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। সরকারি ফি, চুক্তিপত্রসহ সব আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই বৈধভাবে কর্মী পাঠানো হয়। প্রচলিত ব্যবস্থায় রিক্রটিং এজেন্সি কর্মী পাঠাতে বিদেশ থেকে চাহিদাপত্র আনে এবং সংশ্নিষ্ট দেশের ভিসা জোগাড় করে। চাহিদাপত্র জমা দেওয়ার পর বিএমইটি কর্মীর নামে ছাড়পত্র দেয়। কিছু ক্ষেত্রে গন্তব্য দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মীর চাহিদাপত্রের বিপরীতে চাকরি, বেতনের নিশ্চয়তা যাচাই করে সত্যায়ন দেয়। তবে বিএমইটি চাইলে সত্যায়ন ছাড়াও ছাড়পত্র দিতে পারে। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে।
কর্মী দেশ ছাড়ার আগে বিএমইটিকে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে রিক্রুটিং এজেন্সি নিশ্চয়তা দেয় যে, তারা সেখানে চাকরি পাবে। না পেলে নির্যাতিত হলে নিজ খরচে দেশে ফিরিয়ে আনবে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনের ২৯ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন রিক্রুটিং এজেন্টের অবহেলা বা বেআইনি কার্যক্রমের কারণে কোনো অভিবাসী কর্মী বিপদগ্রস্ত হইয়া থাকিলে সরকার সংশ্নিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্টকে উক্ত অভিবাসী কর্মীকে দেশে ফিরাইয়া আনিবার খরচ বহন করিবার নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে।’
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেছেন, কর্মী চাকরি না পেলে এজেন্সি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য। ভিয়েতনামে যারা বিপদে পড়েছেন তাদেরও ফিরিয়ে আনবে এজেন্সি। তবে বিদেশ যাওয়ার আগে চাকরি ও নিরাপত্তা ভালোভাবে যাচাই হলে এমন বিপদ এড়ানো সম্ভব।
ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ সম্প্রতি স্পষ্ট করেই বলেছেন, দেশটিতে বিদেশি কর্মীদের কাজের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ থেকে কেউ যেন চাকরির জন্য দেশটিতে না যান। তবে জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভিয়েতনামে যদি বিদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকে, তাহলে কেন কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিচ্ছে বিএমইটি? তারা বলছেন, চাইলে ঢাকার ভিয়েতনাম দূতাবাস এবং হ্যানয়ের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে যাচাই করে ছাড়পত্র দেওয়া সম্ভব।
তবে বিএমইটি মহাপরিচালক শামসুল আলম বলেছেন, এ কাজটি তাদের নয়। তাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। আইনানুযায়ী ছাড়পত্র একটি নিবন্ধন মাত্র। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার কর্মীর ছাড়পত্র দেওয়া হয়। যা যাচাই কোনোভাবেই সম্ভব নয়। চাহিদাপত্র ও ভিসা আনা এজেন্সিকেই চাকরি, নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে হবে।
ভিয়েতনামে পাঠানো কর্মীরা প্রতারিত হওয়ায় ছয় এজেন্সির সার্ভার লক ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে বিএমইটি। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের কারও বক্তব্য জানা যায়নি।
দেশে ফেরা লালমনিরহাটের কামাল হোসেন, খুলনার শরিফুল ইসলাম, টাঙ্গাইলের মাহমুদুল হাসান বলেছেন, তারা বিনাখরচেই ঘরে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু যে টাকা তারা খরচ করে গিয়েছিলেন, তার কি হবে? ক্ষতিপূরণ কে দেবে? তারা তো অবৈধভাবে বিদেশ যাননি। সরকারি অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবেই গিয়েছিলেন। তারপরও কেন তাদের ঠকতে হলো?
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানব পাচার প্রতিরোধ সম্ভব : জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবার ওয়েবিনারে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেছেন, মানব পাচার চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পানব পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।
সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) সহযোগিতায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এবং উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্প যৌথভাবে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নাসিমা বেগম বলেন, বিদেশ গমনেচ্ছুদের প্রশিক্ষণটা খুব জরুরি। কারণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ সহজে পাচারের শিকার হয় না। যে জানে কোনটা তার জন্য ভালো কোনটা মন্দ।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ও মানব পাচারবিষয়ক জাতীয় কমিটির দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, নজর দিতে হবে মূল সমস্যার দিকে। কারণ মানব পাচারের সবচেয়ে বড় কারণ দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই পাচারকারীদের কবলে পড়তেন না।
অনুষ্ঠানের আরেক অতিথি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোজাফফর আহমেদ বলেন, ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর মাধ্যমেই মূলত মানব পাচার বেশি হয়ে থাকে। পাচারের শিকার তারাই হয় যাদের জানাশোনা কম এবং অদক্ষ। দক্ষরা পাচারের শিকার হন না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ইনসিডিনের পরিচালক একেএম মাসুদ আলী টিআইপির সুপারিশ ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে জোর দেন। জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর তরিকুল ইসলাম বলেন, মানব পাচার সংশ্নিষ্ট মামলাগুলোর যথাযথ মনিটরিং দরকার।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, প্রতিবছরই মানব পাচার মামলার সংখ্যা বাড়ছে। প্রায় ছয় হাজার মামলা হলেও বিচার হচ্ছে না। ২০১৯ সালেও ৬২৫টি মামলা হয়েছে; কিন্তু মাত্র ৩৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে এনজিও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, মানব পাচার বর্তমানে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। এটা প্রাচীনকালেও ছিল, এখনও আছে। তবে ধরন বদলেছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।
সর্বশেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২০, ১১:১২
পাঠকের মন্তব্য