জুলাই মাসের শুরুতে করোনা পরীক্ষার জন্য র্যাপিড টেস্ট অর্থ্যাৎ অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেনের অনুমোদনের জন্য একটি প্রস্তাবনা স্বাস্থ্য অধিদধফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই বা মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছিল। জানা গেছে, চলতি আগস্ট মাসেই করোনার র্যাপিড টেস্ট শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা এই সর্ম্পকে সুপারিশ দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। কিছুটা দেরিতে হলেও করোনার অ্যান্টিবডি এবং অ্যান্টিজেন পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হলে তা করোনা রোগী শনাক্ত, মহামারীতে নেওয়া পরিকল্পনাসহ নানা নীতি নির্ধারণে সাহায্য করবে। অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়, করোনা থেকে যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা। আর অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয়, বর্তমানে রোগীর শরীরে করোনাভাইরাস রয়েছে কিনা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অতি শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে করোনা পরীক্ষার জন্য র্যাপিড টেস্ট। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর সে সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু হবে। অধিদফতর সূত্র জানায়, র্যাপিড টেস্টের যৌক্তিকতা তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতরে কী ধরনের র্যাপিড টেস্ট হতে পারে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠায় গত ৭ জুন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আবার সেটি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তাদের মতামতের জন্য পাঠায়। ইতোমধ্যেই বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ডা. লিয়াকত তাদের মতামত দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ে ঈদের ছুটির শেষে একটি নির্দেশনা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এদিকে, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরও তাদের এই সংক্রান্ত কাজ শেষ করেছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই ওষুধ প্রসাশন অধিদফতর সে অনুযায়ী অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন কিট কেনার জন্য স্পেসিফিকেশন দেবে।
গত ৩ জুন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি করোনা শনাক্তে র্যাপিড টেস্টের জন্য সুপারিশ দেয়। তারা করোনা শনাক্তে এতদিন ধরে চলা আরটি পিসিআর (রির্ভাস ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমারেজ রিঅ্যাকশন) পরীক্ষার সঙ্গে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার জন্য সুপারিশ করেন। সেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার পক্ষেও মত দেয় বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি কমিউনিটিতে কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং সে আক্রান্তদের মধ্যে কত জনের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং তাদের পুনরায় আক্রান্ত হবার আশঙ্কা আছে কিনা সেটি নির্ণয় করা যাবে। রোগী অবস্থা এবং অ্যাপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণা, দুই জায়গাতেই র্যাপিড টেস্টের প্রয়োজন রয়েছে। একইসঙ্গে লকডাউন লিফটিং, পোশাক কারখানাসহ নানা অফিস আদালত খুলে দেওয়ার জন্য, স্বাস্থ্যকর্মীদের কী অবস্থা সেটা বোঝার জন্য, এমন কী ভ্যাকসিন টেস্ট করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা সেখানেও এর উপযোগিতা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক এবং এই সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের সব জায়গায় এখন করোনা পরীক্ষার শনাক্ত করা খুব প্রয়োজন। যদিও সব জায়গাতে পিসিআর ল্যাবরেটরি স্থাপন করা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য কঠিন। তাই অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি যদি কম্বাইন্ড করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পরীক্ষা সুবিধাকে সম্প্রসারণ করা যায় তাহলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা যাবে।’
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেছেন, ‘র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টিং কিট ব্যবহারের নীতিমালা চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন শুধু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ন্যাজাল সোয়াবের মাধ্যমে করা অ্যান্টিজেন টেস্টে আর্লি পজিটিভ বা আর্লি ডিকেটকশন করা যায়। তাই পিসিআর টেস্টের পাশাপাশি অ্যান্টিজেন পরীক্ষা থাকলে রোগী শনাক্ত করা সহজ হয়।’
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে জরুরি রোগী আসে, তাদের তখনই অস্ত্রোপচারের দরকার হয়, সেক্ষেত্রে এটা খুবই দরকারি। সেই রোগীর পজিটিভ নাকি নেগেটিভ সেটা তখন বিচার বিশ্লেষণ করার সময় থাকে না, তাই তখনই অ্যান্টিজেন টেস্ট করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়। তাই র্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দেওয়া উচিত দেশে এবং এই অবস্থাকে মাথায় রেখেই। কারিগরি কমিটি অনেক আগে অ্যান্টিজেন টেস্টের সুপারিশ করেছে।’
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বস্তি এলাকাগুলোতে করোনা রোগী কেন কম? তারা কী আগেই সংক্রমিত হয়ে তাদের অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করেছেন কিনা এসব গবেষণার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন দেওয়া দরকার।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘র্যাপিড টেস্টের অনুমোদন অনেক আগেই দরকার ছিল জিরো সার্ভিলেন্সের জন্য। দেশে কত মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন, কত মানুষ ইমিউন, কারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মীরা-তাদের জন্য র্যাপিড টেস্ট জরুরি। এই নিয়ে জাতীয় পর্যায়েও সিদ্ধান্ত হয়েছিল। করোনা রোগী প্রথম শনাক্তের প্রায় পাঁচ মাস চলে গিয়েছে, এখন এই বিষয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে হবে।’
এদিকে, অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে পারলে ভালো হয় তবে যে ‘মিস ম্যানেজমেন্ট’ হচ্ছে তাতে করে আমরা কিছুটা শঙ্কিত এবং এটা কোনওভাবেই ডায়াগনোসিসের জন্য নয় মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ‘সংক্রমিত হবার দুই থেকে চার সপ্তাহ পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কোনও দেশই অ্যান্টিবডি টেস্ট ডায়াগনোসিসের জন্য ব্যবহার করছে না। তবে এটা ইমিউনিটি দেখার ক্ষেত্রে কার্যকর।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ বিষয়ক সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সদস্য সচিব ডা. রিজওয়ানুল করিম শামীম বলেন, ‘অধিদফতর থেকে প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর সেটি অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে পাঠানো হয় মতামতের জন্য। সে কমিটির মতামতও প্রায় চূড়ান্ত। আশা করছি চলতি মাসেই র্যাপিড টেস্ট সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আমরা পেয়ে যাবো।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত হাতে পেলেই কাজ শুরু হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পলিসি মেকিংয়ে থাকবে। সরকারের পরিকল্পনাতো রয়েছেই, প্রস্তাবনাটা হাতে পেলেই কাজ শুরু হবে। হয়তো চলতি মাসেই সেটা হয়ে যাবে।’
-খবর বাংলা ট্রিবিউন
সর্বশেষ আপডেট: ২ আগস্ট ২০২০, ১৯:২১
পাঠকের মন্তব্য