রাজন উদ্দিন জালাল, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি লিডার : আমি সাধারণত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বিতর্কে জড়াই না। কারণ, আমি মনে করি বাংলাদেশের নেতিবাচক রাজনীতি প্রবাসে আমদানি-রপ্তানির ফলে এখানে আমাদের মধ্যে অনেক ধরনের সমস্যা বিশেষ করে অনৈক্য বেড়েছে। আমি আরো মনে করি, ইউরোপ-আমেরিকা এবং মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেসব এনআরবি বাংলাদেশি রয়েছেন তারা যেখানে বসতি স্থাপন করেছেন সেখানেই নিজেদের অধিকার এবং ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য তাদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
ব্রিটেনে একটি আত্মমর্যাদাশীল কমিউনিটি হিসেবে এখানে আমাদের নিজেদের এবং ভবিষ্যত বংশধরদের গড়ে তোলায় আমাদের সকলের মনোযোগ দেয়া উচিত।
প্রবাসে আমরা সবাই এক একজন বাঙালি ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধি। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভক্তি এসব দায়িত্ব পালনের পথে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে। আর এজন্যই আমি অনেক সময় বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিভিন্ন টিভি ও রেডিওর অনুষ্ঠান আর সভা-সমিতি ইত্যাদিতে যোগ দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখি।
তবে যখন প্রবাসীদের নিয়ে কুচক্রী মহলের কটুক্তি এবং নানা ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও আচরণ নজরে আসে তখন এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দায়িত্ব বলে মনে করি।
আমার আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চলমান লন্ডন- সিলেট ফ্লাইট বন্ধের ষড়যন্ত্র নিয়ে কিছু কথা বলা।
গত ২৭ জুলাই আমার ফেইসবুকে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটের সিডিউল পরিবর্তন নিয়ে হেলাল খানের মন্তব্যটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি নিজে একটি ট্রাভেলসের মালিক। দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সাথে এই ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।
বিমানের একজন এজেন্ট হয়েও তিনি খুব সাহসী বক্তব্য রেখেছেন যা প্রশংসার দাবিদার বলে আমি মনে করি। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁর বক্তব্যটি দেখেছেন হয়ত। কিন্তু তারপরও আমি তার বক্তব্য তুলে ধরতে চাই কারণ তার বক্তব্যের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত পোষণ করি।
ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল হেলাল খান গত ২৭ জুলাই তাঁর ফেইসবুক পোস্টে লিখেন- ‘গতকাল বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স (সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ) একটি নোটিশ দিয়ে আমাদের জানিয়েছে যে, এখন থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সে যারা লন্ডন থেকে সিলেট যাবেন তারা ঢাকায় ইমিগ্রেশন করে সেখানেই তাদের ব্যাগেজ ক্লেইম করতে হবে এবং ঢাকা থেকে আবার নতুন করে বোর্ডিং পাস নিয়ে সিলেটে যাবেন!
কেউ কি ভাবতে পারেন কতটুকু জুলুম-নিপীড়নমূলক মানসিকতা থেকে ঐ সিদ্ধান্তগ্রহণকারীরা এ কাজটি করছেন? একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি-আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্ত ঘামে গড়া দেশের মানুষের সঙ্গে এই অমানবিকতার শেষ হোক!’
বিমানের হঠাৎ করে ফ্লাইট বাতিল নিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক পত্রিকাসহ ব্রিটেনের সবকটি বাংলা মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে রিপোর্ট প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। এসব রিপোর্টের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ব্রিটেনে। কিন্তু এত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরেও বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের এনআরবি বিরোধী সিদ্ধান্ত জায়েজ করতে সক্রিয় রয়েছে। বিমানের এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন করো না আক্রান্ত যাত্রীদের কোয়ারান্টিনে রাখার ব্যবস্থা থাকা ছাড়া আর কোথাও নেই বলেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও দাবি করেছেন এই সিদ্ধান্ত উচ্চপর্যায় থেকে নেয়া হয়েছে। আমি বলতে চাই, যারা এসব কথা বলেন কিংবা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন তাদের অন্তত এটুকু বোধ থাকা উচিত যে বিলেতবাসি বাংলাদেশের নাগরিকরা বোকা নন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশ থেকে যাওয়া যাত্রীদের ঢাকায় কেন কোয়ারেন্টিন করতে হবে? আমি যতোটুকু জানি, ঢাকার ভিড় এবং রাস্তাঘাটে যানজটের তুলনায় সিলেট এবং চট্টগ্রামের কোয়ারেন্টিনের জন্য ঘরবাড়ি-ইমারত এবং খোলা জায়গার পরিমাণ অনেক বেশি।
আমরা জানতে চাই, হঠাৎ করে এই পরিবর্তনের পরোয়ানা কোথা থেকে জারি হয়েছে? যারা এই কাজটি করেছেন তারা কি জানেন কত বছর আন্দোলনের পরে সিলেট এবং চট্টগ্রামের সরাসরি ফ্লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে? এই দাবি আদায় করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে প্রবাসীদের অনেক বঞ্চনা স্বীকার করতে হয়েছে নানা ধরনের আন্দোলন করতে হয়েছে।
লন্ডন-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট চালুর পেছনের কাহিনী না জানলে এই রূটের যাত্রীদের ওপর এই হঠকারী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই। আর যদি তারা জেনেশুনেই এই জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে আমরা মনে করব, তারা ইচ্ছে করেই প্রবাসীদের সাথে তামাশা করছেন এবং এই মহল প্রবাসীদের বিরুদ্ধে সুদুরপ্রসারি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
লন্ডন-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট বাতিলের খবরে বিলেতের কমিউনিটিতে যখন তোলপাড় চলছে তখনই খবর পেলাম যাত্রীদের উপর নতুন আরেকটি এয়ারপোর্ট ট্যাক্স চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে প্রতি যাত্রীকে নাকি আরো ৪০ ডলার করে এখন এয়ারপোর্ট ট্যাক্স দিতে হবে। আমরা জানি না, নতুন এই বিড়ম্বনা যাত্রীদের ওপর কোন যুক্তিতে কে বা কারা চাপিয়েছেন।
বিমান, ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসের দুর্নীতি
এই তিন সরকারি সংস্থায় কর্মরত অসৎ কর্মচারীদের চুরি, ডাকাতি এবং দুর্নীতি সম্পর্কে সকলেই কমবেশি অবগত। আমার সন্দেহ, সিলেট এবং চট্টগ্রামগামী যাত্রীদের ঢাকা হয়ে ভ্রমণে বাধ্য করার পেছনে একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে- দুর্নীতিপরায়ণদের জন্য লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দেয়া। অতীতে বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে, এইসব লুটপাটে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৎপর থাকে। বিমান থেকে দুই হাজার টাকার বিলকে বাড়িয়ে? বিশ হাজার টাকা আদায় করতে হলে তো এরকম শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রয়োজন!
কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনে যাত্রীরা কতভাবে যে হয়রানির শিকার হন এবং অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়ে পরিত্রাণ পান সেসব কাহিনী তো সমাজের সবাই জানেন।
ফিরতি ফ্লাইট ঢাকা হয়ে কেন?
বিমানের ফিরতি ফ্লাইটের ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয় যাতে সাধারণ যাত্রীরা ঢাকায় নামতে বাধ্য হন। ফিরতি পথে বিমানের প্রায় ৯৮% ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীরা সিলেট অথবা চট্টগ্রাম থেকে আসা। বাকি যারা বিনা ভাড়ায় বিমানের বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করেন তারা কেউ সরকারি আমলা কেউবা বিমানের কর্মচারী অথবা তাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিলেট থেকে আসা যাত্রীরা লন্ডন অথবা ম্যানচেস্টারে ফেরত আসার সময় ঢাকায় নামতে বাধ্য হবেন কেন, যুক্তিটা কি? যাত্রী হয়রানি এবং সিন্ডিকেট চক্রের জন্য বিমানের অর্থ লুটপাটের সুযোগ তৈরি করা ছাড়া আমি তো আর এর অন্য কোনো কারণ দেখিনা।
বিমানকর্মীদের যাত্রী সেবার নমুনা
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিমান এবং বিমানবন্দরে কর্মরতদের দুর্ব্যবহার এবং অগ্রহণযোগ্য আচরণের উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। বিগত বছর দশেক ধরে বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ বছর বাংলাদেশে অবস্থানও করেছি।
গত গ্রীষ্মে বিশেষ প্রয়োজনে দেশে গিয়েছিলাম। আমার সফরসঙ্গী ছিলেন পূর্ব লন্ডনের এক সফল ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন গত ৩০ বছর তার সিলেটে যাওয়া হয়নি। তাই এবার ঢাকায় না নেমে বিমানের সরাসরি ফ্লাইটে জন্মস্থান সিলেটে যাবেন। এরই মধ্যে ভিনদেশী এক বন্ধু জানালেন তিনিও এক মাসের জন্য ছুটি কাটাতে আমাদের সাথে বাংলাদেশ যাবেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দা আমাদের ছোটবেলার বন্ধুটি সফল একজন ব্যবসায়ী। অনর্গল সিলেটিতে কথা বলায় পারদর্শী বন্ধুটি জানালেন তিনি এবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবন ঘুরে আসার জন্য দেশের বন্ধুদের কাছ থেকে দাওয়াত পেয়েছেন।
বাংলাদেশে যেতে যে ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে টিকেট কাটা হলো তার মালিক জানালেন, যে মৌসুমে আমরা ভ্রমণ করব তখন ইকোনমি ক্লাস মোটামুটি খালি যাবে এবং আমরা ঘুমিয়ে সিলেট যেতে পারবো। পরামর্শ দিলেন, বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ যাবার সময় আমরা ‘আকাশের নীড়ে’ চড়ে জন্মভূমিতে ঠিকমতো পৌছলাম। কিন্তু লন্ডন ফেরত আসার সময় (নভেম্বর মাস) বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি।
বিমানে উঠে কর্মরত এক বিমানবালাকে আমার অসুস্থ বন্ধুর জন্য ইকনোমি ক্লাসের সামনের একটি খালি সিট জোগাড় করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। তার ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়ার দরকার পড়ে। বিমানবালা আমাদের অনুরোধ রাখলেন না। বিমান ছাড়াও অন্যান্য এয়ারলাইনে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ইকোনমি ক্লাসের কেবিনের পাশের সিটগুলো সাধারণত রোগী, বয়ষ্ক, অসুস্থ অথবা সমস্যাগ্রস্ত যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তবে আমার মনে হয় বাংলাদেশ বিমানের ক্ষেত্রে এসব সিট দেয়া হয় বিভিন্ন ধরনের তদবিরের ভিত্তিতে।
বিমানে কর্মরতদের আরো কিছু আচরণ আমাদেরকে আরো বেশি ক্ষুব্ধ করেছে। একটি উদাহরণ দিলেই যাত্রীদের প্রতি বিমান ক্রু দের মনোভাব স্পষ্ট হবে। একজন যাত্রী কোন এক প্রয়োজনে একবারের বেশি কেবিন ক্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তখন বিমানের একজন স্টুয়ার্ড তাঁর এক বিমানবালাকে বলছেন, ‘তারা মনে করে বিমান তাদের বাপের সম্পত্তি।’ এই কটুক্তিটি নিজের কানে শোনা। বিমানবালার প্রতিক্রিয়ায় বোঝা গেল তিনিও একই মনোভাব পোষণ করেন।
অথচ দেখলাম আমাদের পাশেই আরেকজন যাত্রীকে ওই বিমানবালা বারবার খাবার এবং পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করছেন। বলতে গেলে এই ফ্লাইটের ৯৯ শতাংশ যাত্রী সিলেটের। মনে হল, তাদেরকে উপযুক্ত সেবা দিতে বিমান ক্রুরা নারাজ। অবশ্য অতীতে এর চেয়েও বেশি দুর্ব্যবহার আমাদের দেখতে হয়েছে। বিশেষ করে দুবাইগামী কিংবা দুবাই ফেরত যাত্রীদের সাথে বিমান ক্রুদের আচরণ দেখলে মনে হয় তারা এদেরকে মানুষ বলে গণ্য করেন না। এর কারণ কি? এরা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ বলেই কি তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য?
বিমানে যারা যাত্রীসেবার জন্য চাকরি নেন তাদের যদি নাক এতো উঁচু হয় এবং নিজেদেরকে তারা বেশি শিক্ষিত বলে মনে করেন তাহলে নানা কৌশল অবলম্বন করে এবং বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়ে এই চাকরিতে কেন আসবেন? তাদের এই বোধটুকু নেই যে, এই সিলেট এবং চট্টগ্রামের যাত্রী না থাকলে তাদের চাকরি থাকবে না। নাকি তাদের খুঁটির জোর এতই বেশি যে অভিযোগ করলেও তাদের চাকরি যাবে না এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিন্ত।
ওসমানীকে অপমানের শক্তি কে যোগায়?
ওসমানী সাহেবের উপর বঙ্গবন্ধুর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাসের কারণেই বঙ্গবন্ধু তাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সিলেটের পুরাতন বিমানবন্দরকে সম্প্রসারিত করে এর নাম ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেয়া হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই। তবে বিমানবন্দরটি এখনো শুধু নামেই আন্তর্জাতিক। গত দুই যুগ ধরে নানা অজুহাত (রানওয়ে ছোট, ভারত তার দেশের উপর দিয়ে বিমান উড়তে দেয় না, রিফুয়েলিং ব্যবস্থা নেই ইত্যাদি বাহানা) দিয়ে বিমানবন্দরটিকে সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে না।
সিলেটিদের সাথে এই বৈষম্যমূলক আচরণ অবসানের লক্ষ্যে কয়েক যুগ আগে ‘সিলেট ডিভিশনাল অ্যালায়েন্স’ নামে যুক্তরাজ্যে আমরা একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর লন্ডনে এক ঘরোয়া বৈঠকে তাঁর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। শামসুদ্দিন খান সাহেবের পূর্ব লন্ডনের অফিসে সেই সাক্ষাতে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার বাবা আপনাদেরকে ভালোবাসতেন। আমি একে একে আপনাদের সব দাবি-দাওয়া পূরণ করব।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের প্রশ্ন-
এক. প্রায় দুই যুগ পরও এখনো আমরা লন্ডন থেকে সিলেটের ওসমানী এয়ারপোর্টে সরাসরি যাতায়াত করতে পারছি না কেন?
দুই. দেশ ভ্রমণে গিয়ে কেন সিলেট ও চট্টগ্রামের যাত্রীরা বারবার দুর্ব্যবহার, বৈষম্য আর হয়রানির শিকার হচ্ছেন?
তিন. বাংলাদেশের উন্নয়নের নানা কাহিনী আমরা শুনে থাকি প্রতিনিয়ত। নিজস্ব অর্থায়নে যদি পদ্মা সেতুর কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে ওসমানী বিমানবন্দরকে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতিকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে পারছিনা?
বিলেতের সিলেটী যাত্রী এবং বিমানের ভবিষ্যৎ
দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের শিকার বিমান বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো বেশি সংকটে পড়েছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার কি ভূমিকা রাখবে তা আমরা জানতে চাই?
বিলেতের সিলেটি যাত্রীদের মর্যাদার সাথে দেশভ্রমণ নিশ্চিত করতে সিলেটের মন্ত্রীদের ভূমিকা কী হবে সেটিও আমাদের জানা দরকার। পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানটির মানোন্নয়নে যাত্রীদের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দেয়া উচিত।
লন্ডন সিলেট সরাসরি ফ্লাইট হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়ার পর অনেকেই বলছেন, বিমান বয়কট করতে হবে। এটি হবে একটি চূড়ান্ত নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে আমি মনে করি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং তার সকল সম্পদ বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ। আমরাও সবাই এর অংশীদার। এর কোন ক্ষতি হোক আমরা নিশ্চয়ই তা চাইনা। আমরা বিমানের ফ্লাইটে যেমন মর্যাদাপূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করি তেমনি ওসমানী আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন যাত্রীসেবা চাই।
আমরা চাই, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিমান এবং এর সাথে জড়িত অসাধু চক্রের সিন্ডিকেটকে প্রতিহত করে লন্ডন-সিলেট-লন্ডন রুটে সরাসরি সার্ভিস অবিলম্বে শুরু করবে। আমরা লন্ডন থেকে সিলেট যাওয়ার পথে কিংবা সিলেট থেকে লন্ডন ফেরার পথে ঢাকায় বাড়তি বিড়ম্বনা এবং হয়রানির শিকার হতে চাই না।
বর্তমান দুরবস্থা কাটিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বিমানকে টিকিয়ে রাখা এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে আমার নিচের প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখা যেতে পারে-
এক. বিমানকে প্রাইভেট একটি সংস্থায় রূপান্তরিত করা। বাংলাদেশ বসে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মসাৎ করা জনগনের অর্থ পাচার করছেন তারা সেই অর্থ দিয়ে বিমানের শেয়ার কিনতে পারেন। এই ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ (সিলেট, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার ইত্যাদি) রুটে আমি বিভিন্ন প্রাইভেট এয়ারলাইনে ভ্রমণ করেছি। তাদের সেবার মান আমার কাছে খারাপ মনে হয়নি। আর এই আভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতায় মোকাবেলা করতে গিয়ে বিমানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সেবাও ভালো হয়েছে।
দুই. সিলেট এবং চট্টগ্রাম থেকে অন্যান্য এয়ারলাইনগুলোকেও ফ্লাইট চালুর অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে মুক্তবাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিমানও বাধ্য হয়ে তাদের সেবার মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসবে। আর তা না পারলে বিমান প্রতিযোগিতায় হারবে। এক্ষেত্রে যাত্রীরা সেবার মান বিবেচনা করে তাদের পছন্দের এয়ারলাইন বেছে নিতে পারবেন।
বিদেশের এয়ারলাইনগুলোকে সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিলে তা থেকে আয়ের নতুন পথ খুলবে। আমরা জানি প্রতিবেশী ভারতের সিলেট সংলগ্ন সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতকে এই খাতে সুবিধা দেয়া উচিত নয়। তবে আমার মতে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের উচিত ভারতকেও এই খাতে সুযোগ দেয়া। কারণ ভারতের সাথে আমাদের অন্যান্য বহু ব্যবসা চলছে। প্রতিবেশী ভারতের সাথে পানিবন্টন এবং বাঁধ প্রকল্প নিয়ে আমাদের একাধিক অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। আমি মনে করি, ওসমানী বিমানবন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে সেই অমীমাংসিত বিষয়গুলো আমরা আলোচনার টেবিলে আনতে পারি। আমরা যদি ব্যবসা জানি তাহলে কেউ আমাদেরকে ঠকাতে পারবেনা।
লন্ডন সিলেট সরাসরি ফ্লাইট বন্ধে বিমানের সাম্প্রতিক অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বাংলা পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি স্পষ্ট।
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে গুরুতর সঙ্কটে পড়া এয়ারলাইন্সগুলো এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অথচ বাংলাদেশ বিমান লন্ডন-সিলেট রুটে অন্যান্য এয়ারলাইন্স থেকে এই সংকটকালীন সময়েও দ্বিগুণ ভাড়া ধার্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, কাতার এয়ারলাইন্সের ভাড়া যেখানে ৭০০ পাউন্ডের মতো সেখানে বিমানের ভাড়া প্রায় ১৪ শ পাউন্ড। আন্তর্জাতিক বাজারে এটি মোটেই প্রতিযোগিতামূলক মূল্য হতে পারে না। এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, বিমান এই কঠিন সময়ে ভাড়া দ্বিগুণ করে যাত্রীদের আরেকদফা হয়রানি করতে চায় নাকি বিমানের ভাড়া দ্বিগুণ করে এর ব্যবসা নষ্ট করতে কোন কুচক্রী মহল পাঁয়তারায় লিপ্ত?
সবশেষে, লন্ডন-সিলেট রুটে অবিলম্বে সরাসরি ফ্লাইট চালু এবং ভাড়া গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে প্রবাসীদেরকে আবার প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হবে না বলেই আমি আশা করি।
সর্বশেষ আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২০, ১০:৪০
পাঠকের মন্তব্য