শুধু অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনা নয়, জীবিকা ও জীবনের তাগিদে, সোনালী স্বপ্নের হাতছানিতে সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে। নিজের দেশ, নিজের জন্মভূমি নিজের দেশের মাটি আর প্রবাসজীবনের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান।
প্রবাস জীবন মানে নিষ্ঠুর, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্য থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে দেয়ালবিহীন কারাগারে এতিমের মতে বসবাস করা। কারও দুঃখ কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না। নিজের দুঃখ নিজে অন্তরে রেখে নীরবে কান্না করতে হয়। প্রবাসে যারা এসেছেন একমাত্র তারাই প্রবাসজীবন যে কেমন নির্দয় ও নির্মম তার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।
শস্য-শ্যামলা সবুজেঘেরা সোনার বাংলাদেশ এবং মা-বাবা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের প্রিয় স্ত্রীর মায়া-মমতা ভালোবাসা ত্যাগ করে, সংসারের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, আর্থিক উন্নতির জন্যই প্রবাসের মাটিতে পা রাখতে হয়।
বিদেশে এসে চাকরি করে অনেক টাকাপয়সা বাড়িতে পাঠাব। দুঃখের ছায়ার পরিবর্তে সুখের আলোতে সংসার উজ্জ্বল হবে। এ প্রত্যাশা বুকে নিয়ে আমরা প্রবাসে এসেছি। কিন্তু আমাদের সেই সুখ, সেই সুখের স্বপ্ন সবাই কি পূরণ করতে পেরেছি? না।
বেশির ভাগ প্রবাসীই তাদের আশা-আকাঙ্খা এবং তাদের যে উদ্দেশ্যে প্রবাসে আসা তা বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয় না। কারও মালিক ঠিকমতো বেতন দিচ্ছে না, আবার কেউ দেশ থেকে যে বেতনের কথা শুনে এসেছিল, তারা দেখতে পেল সেই বেতনের সঙ্গে কোনো মিল নেই। আবার সঠিক বেতন পেলেও সে বেতন নিয়মিত নয়।
সবাই যে খারাপ অবস্থায় আছেন তা কিন্তু নয়। অনেক বাংলাদেশি ভাই আছেন তারা ভাল পদে চাকরি করে বেশি বেতন পাচ্ছেন। তাদের পরিবার পরিজনেরা সুন্দরভাবে দিনাতিপাত করছেন।
তাই আমার অনুরোধ যারা বিদেশে চাকরির জন্য নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করার চিন্তাভাবনা করছেন তারা যেন একটু যাচাই বাছাই করে ভিসা এবং কন্ট্রাক্ট ফর্ম দেখে বিদেশে পাড়ি জমান। আর দেশে যদি কোনো ভালো চাকরি করা যায় তবে তাই করা উচিত। দেশের ছেলে দেশের মাটিতে থেকে যে কোনো ভালো চাকরি বা ব্যবসা করতে পারেন তাহলে কোনো কথাই নেই ।
প্রবাসীরা যখন দেশে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন, তখন কেমন আছিস, কোনো
চিন্তা করিস না, আমরা ভালো আছি, বাড়ির সবাই ভালো আছে, কোনো সমস্যা অথবা সমস্যার সমাধান, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে কিনা এই বিষয়গুলোই বলেন। কেউ কেউ অনেক সময় ঝগড়া করে, তর্ক করে, নালিশ করে।
দেশ থেকে যারা ফোন করেন বিশেষত যাদের প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা নেই, তারা একজন প্রবাসীর মনের অবস্থা, তার একাকিত্ব, তার আবেগ, তার কষ্ট, তার উদাসীনতা, তার নীরব কান্না এগুলো বুঝতে পারেন না। এই অনুভূতিগুলো অনুভব করাও তাদের পক্ষে সম্ভব না। প্রবাসীজীবনে প্রবাসীরাই এইগুলো বেশি অনুভব করেন।
প্রবাসী আমাদের মনে অনেক কষ্ট। কারণ আমরা মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে বন্দী জীবন কাটাই। সকালে উঠে কাজে যেতে হয় আর রাতে ফিরি। দুপুরে পলিথিন ব্যাগে রাখা খাবার খেতে হয়। কখনো ভালো থাকে আবার কখনো বা খাবার নষ্ট হয়ে যায়।
প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শুনেও কিছু করার থাকে না। এমন হতভাগ্য আমরা। যখন কেউ একটু অসুস্থ হয় তখন পাশে কেউ থাকে না সেবা করার। অসুস্থকে রেখে সবাই চলে যায় সবার কাজে। কারও একটু সময় নাই তার পাশে থাকার।
হায়রে প্রবাস! এই প্রবাসে এসে কতো আপন মানুষ হয়ে গেল পর। কতদিন চলে গেল, বোনের ভাইয়া ডাক শুনতে পাইনা। মা বলে না, আয় খোকা আমি নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দিব। কতদিন আর কতদিন এভাবে কাটাব? জানি না। আমরা কবে এই দাসত্ব থেকে মুক্ত হব।
তার পরও আমরা চাই আমাদের প্রিয়জনের মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলতে। রাত যায়, দিন যায়, থাকি পড়ে একা। রোজা যায়, ঈদ যায়, যায় কতো সুখের দিন, দেশের মানুষ কতো আনন্দ করে, আমরা তা দেখি প্রতিদিন। তবুও আমরা অনেক সুখ পাই যখন শুনতে পাই তোমরা আছ সুখে, আমরা ভালো আছি প্রবাসে জীবনের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে ভুলে।
সকলের কাছে অনুরোধ, যারা দেশে আছেন আর বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-সজন অথবা পুত্র-কন্যা কিংবা স্বামী-স্ত্রী যেই প্রবাসী হোক না কেন সব কিছুর মধ্য দিয়ে প্রবাসীদের সেই কষ্ট, অনভূতি, বেদনা, নীরব কান্না একটু বোঝার চেষ্টা করবেন। তাদেরকে যতখানি সম্ভব একাকিত্ব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবেন। তাদেরকে যতখানি সম্ভব নিজেদের কাছে রাখার চেষ্টা করবেন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আপনার বিশেষ এই অনুভূতি একজন প্রবাসীর জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলবে। তার প্রবাস জীবন কতখানি আনন্দময় হয়ে উঠবে।
আপনাদের বাবা, ভাই, স্বামী যেই প্রবাসে থাকুক না কেন, তাদেরকে একটু সুখ দিতে চেষ্টা করবেন এই বাংলাদেশ থেকে। আর আমার মনে হয় যখন কেউ তার প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলে একটু আনন্দবোধ করে তার কাছে কষ্টকে আর কষ্ট মনে হয় না।
সর্বশেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২০, ০০:৪৪
পাঠকের মন্তব্য