করোনার মহামারীসহ বিভিন্ন কারণে বিপর্যস্ত বিমানকে টেনে তুলতে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুট বাড়ানোরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আর দ্রুত সময়ের মধ্যে আরও ৩টি ড্যাশ-৮ বিমান আনা হচ্ছে। একইসঙ্গে থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পেতে দক্ষ জনবল নিয়োগ, যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং নতুন আরও একটি হ্যাঙ্গার নির্মাণ হবে।
আর বিমানে শুদ্ধি অভিযান চালানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নানা অপকর্মে জড়িত তাদের তালিকা করা হয়েছে। এজন্য সরকারের কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় চলতি অর্থবছরের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বিমান একটি শক্তিশালী এয়ারলাইনসে পরিণত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও সিনিয়র সচিব মহিবুল হক বলেন, বিমান নতুন ব্যবস্থাপনায় যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল, হঠাৎ করোনা তান্ডবে ততটাই নিম্নমুখী হয়ে এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা। বিমান এই পরিকল্পনায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, একটি এয়ারলাইনসে যত বেশি উড়োজাহাজ থাকবে, তত বেশি বাণিজ্যিক সুবিধা মিলবে। বহর শক্তিশালী হলে বিমানের সেবা ও বাণিজ্য বাড়বে এটা বিলম্ব হলেও বুঝতে পেরেছে কর্র্তৃপক্ষ। বর্তমানে ছোট আকারের উড়োজাহাজের অভাবে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীদের প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছে না। এজন্য আরও ৩টি ড্যাশ ৮ নেওয়া হচ্ছে। আসছে নভেম্বরে বিমান বহরে নতুন ১টি ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ এনজি মডেলের উড়োজাহাজ বিমান বহরে যুক্ত হচ্ছে। বাকি দুটি যুক্ত হবে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে।
বিমান কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই তিনটি ড্যাশ ৮ চলতি বছরেরর মার্চ, মে ও জুনে সরবরাহ করার কথা ছিল কানাডার বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বম্বার্ডিয়ার ইনকরপোরেশনের। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে সময়মতো বিমানগুলো সরবরাহ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিমানের জন্য ৩টি উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশ ও কানাডা সরকারের মধ্যে জিটুজি পদ্ধতিতে সরাসরি ক্রয় চুক্তি হয়।
এজন্য ঋণ সহায়তা দিয়েছে কানাডা সরকারের প্রতিষ্ঠান এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট কানাডা। উড়োজাহাজ বাড়ালে রুটও বাড়াতে হবে। এক সময় বিমানের ছিল ২৯ গন্তব্য। বর্তমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও সিনিয়র সচিব মহিবুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর অতীতের রুটগুলো ফের চালুর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় টরন্টো, টোকিও, গুয়াংজু ও চেন্নাই রুটে ডানা মেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিমান।
অক্টোবরেই টরেন্টো ফ্লাইট চালু হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোকাব্বির হোসেন। তিনি জানান, নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সূচি। যাত্রী সংকট থাকায় কভিড-পরবর্তী সময়ে নতুন রুট চালুর সিদ্ধান্ত বুঝেশুনে নিতে হবে।
গত দু’বছরে বিমান বহরে ৬টি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ যোগ হলেও রুট বেড়েছে মাত্র তিনটি। চলতি বছর একাধিক নতুন রুটে যাত্রার উদ্যোগও পিছিয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের মহামারীতে। বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা না তোলায় বিদ্যমান ১৮টি রুটের মধ্যে বর্তমানে মাত্র চারটি রুটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। এরমধ্যে টোকিও, টরন্টোসহ নতুন চারটি রুটে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে এছাড়া নতুন রুটের সন্ধান করছে বিমান।
জানা গেছে, বিমানে গত বিশ বছর ধরে নেই কোনো বড় ধরনের অফিসার নিয়োগ। এখন যারা বিমানের শীর্ষ স্তরে কর্মরত, তাদের শতকরা ৮০ ভাগই পদোন্নতিপ্রাপ্ত। বছর তিনেক আগে কজন অফিসার নিয়োগ দিতে গিয়েও হোঁচট খায় সিবিএর কারণে। ফলে দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার পাশাপাশি লাভের ধারা অব্যাহত রাখতে গত ২৯ জুলাই সরকারের কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় বিমান ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এই চুক্তিতে বিমান নিজেদের পরিকল্পনার বিষয়টি তুলে ধরে। এতে বিমানের চারটি পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে স্ট্র্যাটেজিক হিউম্যান ক্যাপিটাল প্ল্যানিং প্রণয়ন করা। এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, বিভিন্ন ট্রেড প্রশিক্ষণ প্রদান, যথাযথ পদায়ন, মূল্যায়ন, প্রণোদনার মাধ্যমে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলা।
বর্তমানে বিমানের রয়েছে একটি হ্যাঙ্গার, যার অবস্থান ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর পাশে। এই হ্যাঙ্গারে বর্তমানে উড়োজাহাজের সি চেক করা সম্ভব। পাশাপাশি দেশি বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইনসেরও রক্ষণাবেক্ষণ সেবা মিলছে এখানে। এতে মেরামত খরচ কমানোর পাশাপাশি অন্য এয়ারলাইনসগুলোকে প্রকৌশল সেবা দিয়ে বিমানের আয় বাড়ছে।
এ আয় ও সেবাকে অধিকতর বাণিজ্যিক করতে আরও একটি বিশ্বমানের হ্যাঙ্গার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য একটি পরিকল্পনাপত্র ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই পরিকল্পনায় বর্তমান হ্যাঙ্গারেই আরও সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি একটি নতুন হ্যাঙ্গার নির্মাণ করা গেলে বিমান লাভবান হবে। এছাড়া বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে আইএসএজিও সনদ অর্জন ও উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণে ইএএসএ ১৪৫ সনদ অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে বিমান।
বিমানের এক কর্মকর্তা জানান, সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হবে বিমানের বর্তমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ধরে রাখা। তারপর থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পাওয়া। এজন্য বিমানকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। যদিও বিমান মন্ত্রণালয় আগেই ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে এককভাবে কাউকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ দেওয়া হবে না।
আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে থার্ড টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ দেওয়া হবে। এখন থেকেই বিমানকে সেভাবে দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে বিমানের রাজস্ব আয়ের এই খাতটি ধরে রাখার পাশাপাশি থার্ড টার্মিনালের দায়িত্বও নেওয়া যায়। বিমান সেই কর্মপরিকল্পনা ধরেই অগ্রসর হচ্ছে।
সর্বশেষ আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২০, ০৯:৩৩
পাঠকের মন্তব্য